প্রতীকী ছবিদেশে
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশই
শনাক্ত হয়েছে সংক্রমণের দ্বিতীয় মাসে। আজ শুক্রবার দেশে করোনা (কোভিড-১৯)
সংক্রমণ শনাক্তের দুই মাস পূর্ণ হচ্ছে।
বিশ্বে যেসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেসব দেশেও প্রথম দুই মাসে মোট আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশের বেশি শনাক্ত হয়েছিল দ্বিতীয় মাসে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে এখনো সংক্রমণের
প্রথম ঢেউ চলছে। গত এক মাস পুরোটাই ছিল সরকারি ছুটি বা অনেকটা লকডাউন
(অবরুদ্ধ) পরিস্থিতির মধ্যে। এর মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
ইতিমধ্যে সীমিত পরিসরে পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। দোকানপাটও খুলে দেওয়া
হচ্ছে। ফলে নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আক্রান্তের
শীর্ষে থাকা দেশগুলোতেও সংক্রমণের তৃতীয় মাসে গিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ
হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও রোগী বাড়ছে। তবে ওই সব দেশে সংক্রমণের দুই মাসের
মাথায় আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল। ওই দেশগুলোতে শনাক্তের
পরীক্ষাও অনেক বেশি হয়েছে।
দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের খবর জানানো হয় ৮ মার্চ।
এর এক মাসের মাথায় ৮ এপ্রিল দেশে মোট রোগী ছিলেন ২১৮ জন। ওই সময় পর্যন্ত
সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল ২২ জেলায়। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি
ঘোষণা করা হয়। প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের দুই মাসের মাথায় এসে দেশে মোট রোগী
শনাক্ত হন ১২ হাজার ৪২৫ জন। দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত বেড়েছে ১২ হাজার ৬০৭
জন, যা মোট শনাক্তের ৯৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত এক মাসে নতুন ৪২টি জেলায়
সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
দেশে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে মোট ১৯৯ জন মারা
গেছেন। এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর সুস্থ
হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৯১০ জন। গতকাল পর্যন্ত সুস্থতার
হার ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে এখনো সংক্রমণের প্রথম ঢেউ চলছে। সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,
যুক্তরাষ্ট্রে দুই মাস শেষে মোট আক্রান্ত ছিলেন ১৫ হাজার ২১৯ জন। মোট
আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ৯০ ভাগই আক্রান্ত হয় দ্বিতীয় মাসে। ইতালিতে সংক্রমণের
দুই মাসে মোট আক্রান্ত ছিলেন ৯২ হাজার ৪৭২ জন। এর ৯৮ দশমিক ৭৮ শতাংশই
দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত হয়। স্পেনে দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই সময়
পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে প্রথম দুই মাসে মোট
আক্রান্ত ছিলেন ২৫ হাজার ১৫৪ জন। এর ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশই আক্রান্ত হয়
দ্বিতীয় মাসে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ
করেছিল তৃতীয় মাসে। প্রথম দুই মাসের তুলনায় তৃতীয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৭
শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৮৫ শতাংশ রোগী বেড়েছিল। স্পেনে এটি ছিল ৫৫ ও ইতালিতে
৫৪ শতাংশ।
পরীক্ষা বাড়ছে, রোগীও বাড়ছে
দেশে
শুরুতে শুধু রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর)
পরীক্ষা সীমিত ছিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানোর
উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল প্রথম এক দিনে ১০০-এর বেশি রোগী শনাক্ত হয়। ১০
দিন ধরে প্রতিদিন ৫০০-এর বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে তিন দিন ধরে
দৈনিক শনাক্ত হচ্ছে ৭০০-এর বেশি রোগী।
২৩ এপ্রিল
পর্যন্ত দেশে মোট ৩৬ হাজার ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখন ৩৪টি
প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। গতকাল পরীক্ষাকৃত মোট নমুনার সংখ্যা
লাখ ছাড়িয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৫১৩টি নমুনা পরীক্ষা করা
হয়। পরীক্ষা করা নমুনার ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ পজিটিভ বা সংক্রমিত।
যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে পজিটিভ নমুনা পাওয়ার হার ৯ থেকে
১৬ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ৭০৬, মৃত্যু ১৩
গতকাল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে গত ২৪ ঘণ্টার হালনাগাদ তথ্য
তুলে ধরেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, গত
২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৮৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭০৬ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া
যায়। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত দাঁড়ায় ১২ হাজার ৪২৫। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে
হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৩০ জন।
গতকালের বুলেটিনে ২৪ ঘণ্টার মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়নি। পরে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জন
মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে ৮ জন পুরুষ, ৫ জন নারী। ৬ জন ষাটোর্ধ্ব, ৪ জনের
বয়স ৫১-৬০ বছরের মধ্যে, ২ জন ৪১-৫০ বছরের মধ্যে। ১ জনের বয়স ১১-২০ বছরের
মধ্যে, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
ঢাকা ও আশপাশে সংক্রমণ বেশি
শুরুতে
সংক্রমণ সীমিত ছিল বিদেশফেরত এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের মধ্যে। ২৬
মার্চের আগ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৯ জনের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন ৮টি দেশ থেকে আসা
ব্যক্তি। আর ২৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে গিয়ে।
বাকি দুজন কীভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন, তা অজানা। ২৫ মার্চ বলা হয়, সীমিত
পরিসরে লোকাল ট্রান্সমিশন (স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ) হয়ে থাকতে পারে।
৫ এপ্রিল রাজধানীর টোলারবাগ ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ,
মাদারীপুর (শিবচর) এবং গাইবান্ধা (সাদুল্যাপুর)—এই পাঁচটি জায়গাকে
সংক্রমণের ক্লাস্টার (কাছাকাছি একই জায়গায় অনেক আক্রান্ত) হিসেবে চিহ্নিত
করে আইইডিসিআর। এই পাঁচটি জায়গার চারটিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও
নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে চলে যায় নারায়ণগঞ্জ। ৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ
লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সেখান থেকে অনেকে ছড়িয়ে পড়ে
দেশের বিভিন্ন জেলায়। ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জকে সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রস্থল
হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর।
শুরু থেকে রাজধানীতে আক্রান্ত ছিলেন বেশি। এখনো মোট
আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি রাজধানীর বাসিন্দা। নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত হাজার
ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম,
ঢাকা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার প্রতিটিতে আক্রান্ত ১০০ ছাড়িয়ে গেছে।
আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে
বলেন, দেশে মহামারির প্রথম ঢেউ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলছে দ্বিতীয় ঢেউ।
একদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের সঙ্গে দেশের সংক্রমণের ধারার মিল
রয়েছে। আবার অন্যদিক থেকে তুলনা করা যায় না। কারণ, ইতালির লোম্বার্ডি
অঞ্চলে আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ঘনীভূত মহামারি দেখা গেছে। তবে
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোগতত্ত্ববিদের মতে,
ঈদ সামনে রেখে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তাতে ঝুঁকি বাড়ছে।